মানব প্রজননে হরমোনের ভূমিকা

হরমোন

 যে জৈব রাসায়নিক পদার্থ নালীহীন গ্রন্থির থেকে নিঃসৃত হয় এবং সরাসরি রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় ও শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে তাকে হরমোন বলে ।

হরমোন কে রাসায়নিক দূত বলা হয় কেন?

 হরমোন কে রাসায়নিক  দুত বলা হয় কারণ হরমোন সরাসরি রক্তের মাধ্যমে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় ও শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে , বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটাতে সাহায্য করে। হরমোন নির্দিষ্ট অথচ স্বল্পমাত্রায় নিঃসৃত হয় নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। 

প্রজনন সংক্রান্ত হরমোন

নিচে প্রজনন সংক্রান্ত হরমোন এর নাম ও কাজ দেওয়া হল-

১.  পিটুইটারি গ্রন্থি

এ গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন ধরনের  বৃদ্ধি উদ্দীপক হরমোন এবং উৎপাদক হরমোন নিঃসৃত হয়।  এ হরমোনগুলো জনন গ্রন্থি বৃদ্ধি, ক্ষরণ এবং কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, মাতৃ দেহে স্তন গ্রন্থি বৃদ্ধি এবং দুগ্ধ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া এগুলো জরায়ুর সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে।

২. থাইরয়েড গ্রন্থি

এই গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি, যৌন লক্ষণ প্রকাশ এবং বিপাকে সহায়তা করে।

৩. অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি

 এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত কিছু হরমোন যৌনাঙ্গের বৃদ্ধি ও যৌন লক্ষণ প্রকাশের সহায়তা করে।

৪. শুক্রাশয় এর অনালগ্রন্থি 

এই গ্রন্থি থেকে টেস্টোস্টেরন ও এন্ড্রোজেন হরমোন নিঃসৃত হয় যা শুক্রাণুর উৎপাদন ,দাড়ি গোফ গজানো , গলার স্বর পরিবর্তন ইত্যাদি যৌন লক্ষণ প্রকাশ করে।

৫. ডিম্বাশয়ের অনালগ্রন্থি 

 এই গ্রন্থি থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় যা ডিম্বাণু উৎপাদন, মেয়েদের নারীসুলভ লক্ষণগুলো সৃষ্টি, ঋতুচক্র নিয়ন্ত্রণ এবং গর্ভাবস্থায় জরায়ু, ভ্রুন, অমরা ইত্যাদি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। 

৬. অমরা

 এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত  গোনাডোট্রপিন ও প্রজেস্টেরন ডিম্বাশয়ের অনাল গ্রন্থি কে উত্তেজিত করে এবং স্তন গ্রন্থি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। 

বয়ঃসন্ধিকাল 

সেকেন্ডারি যৌন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভবসহ  জননাঙ্গের সক্রিয় পরিস্ফুটন কালই হলো বয়ঃপ্রাপ্তি বা বয়ঃসন্ধিকাল ।এক কথায়, কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিকালই হল বয়ঃসন্ধিকাল ।বয়সন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের দৈহিক, মানসিক ও যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটে এবং প্রজননতন্ত্রের অঙ্গগুলোর বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটতে শুরু করে হরমোনের প্রভাবে ।

নিচে বয়সন্ধিকালে ছেলেদের পরিবর্তনগুলো দেওয়া হবে-

১.ছেলেদের দাড়ি গোফ গজায়।

২. ছেলেদের গলার স্বর পরিবর্তন হয়।

৩. কাঁধ চওড়া হয়।

৪ প্রজনন তন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত অঙ্গগুলোর বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে ।

 নিচে বয়সন্ধিকালে মেয়েদের পরিবর্তন গুলো দেওয়া হল-

১.মেয়েদের দেহ ত্বক কোমল হয়

২. মেয়েদের চেহারার কমনীয়তা বৃদ্ধি পায়

৩. নির্দিষ্ট সময় পর পর ঋতুস্রাব হয়

৪ স্ত্রী জননতন্ত্র সাথে সম্পৃক্ত অঙ্গগুলোর বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে। 

 

মানব ভ্রূণের বিকাশ 

পরিণত শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলন ঘটায় স্ত্রীর ডিম্বনালীতে। নিষিক্ত ডিম্বাণু ধীরেধীরে ডিম্বনালি জরায়ুর দিকে অগ্রসর হয় এবং একই সাথে এর কোষ বিভাজন বা ক্লিভেজ চলতে থাকে ।কোষ বিভাজনের শেষ পর্যায়ে এটি পরিণত হয় ডিম্বনালী থেকে জরায়ুতে  পৌঁছায় ।এ পর্যায়ে ভ্রূণকে ব্লাস্টোসিস্ট বলে। ব্লাস্টোসিস্ট অবস্থায় ভ্রুণ এপর্যায়ে জরায়ুর প্রাচীরের স্থাপিত হয়। একে গর্ভধারণ বলে। এই অবস্থায় ভ্রূণটি বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে মানব শিশুতে পরিণত হয় । গর্ভধারণের ৩৮ থেকে ৪০ সপ্তাহ পর মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। এভাবে নিষেকের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানব ভ্রূণের বিকাশ ঘটে ।

অমরা 

যে বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে মাতৃ জরায়ুতে ক্রমবর্ধমান ভ্রুন এবং মাতৃ জরায়ু টিস্যুর  মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাকে অমরা বা গর্ভফুল বলে।

গঠনঃ

 ক্রমবর্ধনশীল ভ্রুনের কিছু  কোষ এবং মাতৃ জরায়ুর অন্তঃস্তরের কিছু কোষ মিলিত হয়ে ডিম্বাকার ও রক্তনালী সমৃদ্ধ অমরা তৈরি করে। নিষেকের 12 সপ্তাহের মধ্যে অমরা গঠিত হয়। এভাবে ভ্রূণ এবং মাতৃ জরায়ুর অন্তঃস্তরের মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে অমরা গঠিত হয়। প্রসবের সময় ওমরা দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়। 

কাজঃ

১. অমরা ভ্রুনকে জরায়ুর সাথে স্থাপিত করে ।

২. ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তথা শর্করা, আমিষ, স্নেহ, পানি এবং খনিজ লবণ ইত্যাদি অমরার মাধ্যমে মায়ের রক্ত হতে ভ্রূণের রক্তে প্রবেশ করে ।

৩. অমর অনেকটা ফুসফুসের মত কাজ করে। কারণ অমরার মাধ্যমেই ভ্রুণ মায়ের রক্ত থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং ভ্রূণ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর বিনিময় ঘটে ।

৪. আমরা বৃক্কের মত কাজ করে অর্থাৎ বিপাকের ফলে যেবর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হয় তা অমরার মাধ্যমে ভ্রুণ দেহ হতে অপসারিত হয়।

৫. অমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে যা ভ্রূণের রক্ষণাবেক্ষণ ও তার স্বাভাবিক গঠনে সাহায্য করে।

৬. অমরাতে প্রচুর রক্তনালী থাকে যার ভেতর দিয়ে মাতৃ দেহের সাথে বোনের বিভিন্ন পদার্থের বিনিময় ঘটে। 

৭. গর্ভাবস্থায় অমরা থেকে এমন কতগুলো হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মাতৃ দুগ্ধ উৎপাদন এবং প্রসব সহজ করতে সহায়তা করে। 

কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা

 ক্লিভেজঃ  

নিষিক্ত ডিম্বানুর ধীরে ধীরে ডিম্বনালীতে জরায়ুর দিকে অগ্রসর হবার সময় নিষিক্ত ডিম্বানুর কোষ বিভাজন ঘটে । একে ক্লিভেজ বলে ।

ব্লাস্টোসিস্টঃ

নিষিক্ত ডিম্বানুর কোষ বিভাজনের শেষ পর্যায়ে যখন গঠন্মুখ ব্রুনো ডিম্বনালী থেকে জরায়ুতে পৌঁছায় তখন ঐ পর্যায়ের গুলোকে ব্লাস্টোসিস্ট বলে ।

গর্ভধারণঃ

ব্লাস্টোসিস্ট পর্যায়ের ভ্রুণ জরায়ুর প্রাচীরের সংস্থাপিত হলে তাকে গর্ভধারণ বলে।

 গর্ভাবস্থাঃ

জরায়ুর অন্তঃগাত্রে ভ্রূণের সংস্থাপিত হওয়ার পর থেকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়কে গর্ভাবস্থা বলে।  সাধারণত 38 থেকে 40 সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভাবস্থা বিদ্যমান থাকে।

আম্বিলিকাল কর্ডঃ

অমরা ও ভ্রূণের মধ্যে সংযোগকারী নালী কাকে বলা হয় আম্বিলিকাল কর্ড।  এর ভিতর দিয়ে মাতৃ দেহের সাথে ভ্রুনের বিভিন্ন পদার্থের বিনিময় ঘটে।

 ভ্রূণ আবরণীঃ

মাতৃ দেহের ভেতর ভ্রূণের সহজ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ পরিবর্ধনের জন্য ভ্রূণের চারদিকে কতগুলো আবরণ থাকে যা ভ্রূণের পুষ্টি, গ্যাসীয় আদান-প্রদান, বর্জ্য নিষ্কাশন সহ ভ্রূণকে রক্ষা করে একে ভ্রূণ আবরণী বলে ।

 মরুলাঃ 

নিষেকের প্রায় 72 ঘন্টা পর 16 কোর বিশিষ্ট বলের মত আকারের গঠনকে মৌলা বলে। 

ফিটাসঃ

প্রায় আট সপ্তাহ বয়স্ক ভ্রুণ কে বলা হয় ফিটাস ।

প্রসব বেদনাঃ 

শিশু সন্তান প্রসবের পূর্বে জরায়ুর নির্দিষ্ট ব্যবধানের সংকুচিত হতে থাকে এবং ব্যথা-বেদনার সৃষ্টি হয়। এই ক্রমবর্ধমান বেদনাকে প্রসববেদনা বা লেবার পেইন বলে।

ঋতুস্রাবঃ

বয়সন্ধিকাল থেকে মেয়েদের নির্দিষ্ট সময় পরপর রক্তস্রাব হয় । একে ঋতুস্রাব বা মাসিক বলে। 

মেনোপজঃ

বয়সন্ধিকালের এক থেকে দুই বছর পর মেয়েদের ঋতুস্রাব হয় অর্থাৎ তারা প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে এবং 40 থেকে 50 বছর বয়স পর্যন্ত ঋতুস্রাব চলতে থাকে এর পর তা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় । একে মনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি কাল বলে।

পরাগনালিঃ

উদ্ভিদের পরাগ রেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুণ্ডে পতিত হবার পর প্রস্ফুটিত হয়ে জেনালি গঠন করে গর্ভাশয় মুখে যাত্রা করে তাকে পরাগনালি বলে।

র্ভযন্ত্রঃ

উদ্ভিদের বন্ধনীর ডিম্বকরন্ধ্র দিকের কোষ দিনটিকে একত্রে গর্ভযন্ত্র বলে ।গর্ভযন্ত্রের মাঝে সবচেয়ে বড় কোষটিকে বলা হয় ডিম্বাণু এবং ডিম্বানুর দুইপাশের কোষদুটিকে বলা হয় সহকারী কোষ।